ছবি : সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা, সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধ এবং সামাজিক সমস্যা নিরসন শীর্ষক আলোচনা সভায় কিরাত পরিবেশন করছেন- হাফিজ কারী সাব্বির আহমদ
সবুজে মোড়া শান্তিপূর্ণ পরিবেশে বেড়ে উঠা এক তরুণ, যার স্বপ্ন সমাজে আলোকিত মানুষ গড়া; তার নাম সাব্বির আহমদ। মৌলভীবাজার জেলার জুড়ী উপজেলার জামকান্দি গ্রামের সন্তান এই তরুণ একাধারে হাফিজ, কারী, শিক্ষক, ইমাম, লেখক, গবেষক, কবি, কন্টেন্ট ক্রিয়েটর ও সাংবাদিক। তিনি নতুন প্রজন্মের কাছে এক উজ্জ্বল অনুকরণীয় নাম।
২০০৩ সালের ৩০ অক্টোবর বৃহস্পতিবার রাত আনুমানিক ২টায়, জুড়ী উপজেলার পূর্বাঞ্চলীয় জামকান্দি গ্রামে এলাইছ মিয়া ও হবিবুন নেছা দম্পতির ঘরে জন্মগ্রহণ করেন সাব্বির আহমদ। ছয় ভাই-বোনের মধ্যে কনিষ্ঠ তিনি। তার শৈশব কেটেছে মক্তব পড়া ও প্রতিবেশীদের সাথে খেলাধুলার মধ্য দিয়ে।
শিক্ষাজীবনের সূচনা হয় দূর্গাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, যেখানে থেকে ২০১৩ সালে পিএসসি পরীক্ষায় A গ্রেডে উত্তীর্ণ হন। এরপর নিজ গ্রামের হাজী মাহমুদ আলী দাখিল মাদ্রাসায় ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন এবং পাশাপাশি কুরআন হিফজের চর্চা শুরু করেন।
২০১৬ সালে ভর্তি হন জুড়ী জালালিয়া হাফিজিয়া মাদ্রাসায় এবং ২০১৮ সালে হিফজ সম্পন্ন করেন। পরে ২০১৯ সালে জাংগীরাঈ দাখিল মাদ্রাসায় অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে ২০২২ সালে দাখিল পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে A গ্রেডে উত্তীর্ণ হন। এরপর নয়াবাজার আহমদিয়া ফাযিল মাদ্রাসায় আলিম শ্রেণিতে অধ্যয়ন শেষে ২০২৪ সালের আলিম পরীক্ষায় আবারো A গ্রেডে উত্তীর্ণ হয়ে ভর্তি হন সিলেট সরকারি আলিয়া মাদ্রাসার আল-কুরআন অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে। বর্তমানে তিনি সেখানে অধ্যয়নরত।
হিফজ শেষে ২০২০ সালে জুড়ী জালালিয়া হাফিজিয়া মাদ্রাসার বার্ষিক মাহফিলে আল্লামা কামরুদ্দিন চৌধুরী ফুলতলীর হাত থেকে হাফিজ হিসেবে পাগড়ি ও সনদ লাভ করেন। ২০১৯ সালে দারুল কিরাত মজিদিয়া ফুলতলী ট্রাস্ট থেকে কারিয়ানা সম্পন্ন করে কারী উপাধি ও সনদ অর্জন করেন।
তিনি বিয়ানীবাজারের হযরত হায়দর শাহ (রহ.) হাফিজিয়া মাদ্রাসা ও ইমামবাড়ী মাদ্রাসা খ্যাত হযরত গোলাব শাহ (রহ.) হাফিজিয়া মাদ্রাসায় একাধিকবার হিফজ শুনানির মাধ্যমে সনদ ও সম্মাননা লাভ করেছেন।
একজন আদর্শ শিক্ষক হিসেবে নিজেকে তৈরি করার লক্ষ্যে তিনি ২০২২ সালে ঢাকার কেরানীগঞ্জ থেকে হুফফাজুল কুরআন ফাউন্ডেশন এর হিফজ শিক্ষক প্রশিক্ষণে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে লাভ করেন "মুমতাজুল হুফফাজ" উপাধি। ২০২৫ এর এপ্রিল-মে মাসে ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর অধীনে ইমাম প্রশিক্ষণ একাডেমি সিলেট কেন্দ্র থেকে ৪৫ দিনব্যাপী ইমাম প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন এবং প্রথম বিভাগে উত্তির্ন হয়ে সনদপ্রাপ্ত আদর্শ ইমাম হিসেবে স্বীকৃতি পান।
২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে হাজী মজম্মিল আলী মখরুন নেছা হাফিজিয়া মাদ্রাসায় সহকারী শিক্ষক (বোডিং সুপার) এবং হাজী উসতার আলী জামে মসজিদে ইমাম হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। উচ্চশিক্ষা গ্রহণের কারণে সেখান থেকে সম্প্রতি অব্যাহতি নিয়েছেন।
২০১৯ সালে গোলাপগঞ্জের সোনামপুর বাজার জামে মসজিদে রামাদ্বান মাসে খতম তারাবীহের মাধ্যমে তার ইমামতি সূচনা হয়। এরপরের বছরগুলোতে ধারাবাহিকভাবে ঢাকার ফুলতলী কমপ্লেক্স জামে মসজিদ, জুড়ী নামাবাজার জামে মসজিদ ও নিজ এলাকার হাজী উসতার আলী জামে মসজিদে তারাবীহ ও দারুল কিরাত পড়ান।
এছাড়া তিনি বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিল, কিরাত সম্মেলন, নাশিদ সন্ধ্যা ইত্যাদিতে অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে হামদ নাত সহ আন্তর্জাতিক মানে কিরাত পাঠ করে থাকেন। গত বছর সিলেট সরকারি আলিয়া মাঠে কিরাতুল কুরআন পরিষদ এর উদ্দ্যোগে আয়োজিত আন্তর্জাতিক কিরাত সম্মেলনে তাকে কিরাত পাঠ করতে দেখা যায়৷
সাব্বির আহমদ শুধু একজন হাফিজ কারী আর শিক্ষকই নন, বরং তিনি একজন প্রাণবন্ত কবি ও সাহিত্যপ্রেমী হিসেবে তার লেখায় স্থান পায় সমাজের বাস্তবতা, প্রকৃতি ও দ্বীনের আলো। তার কবিতাগুলোর মধ্য উল্লেখযোগ্য কবিতা: "দ্বীনের দীপ্ত সন্তান", "মানুষে মানুষে ভেদাভেদ", "আশার আলো", "এবার ভিন্ন কিছু হোক" ইত্যাদি। তিনি তার লিখিত কবিতা দিয়ে "মেছাবের মানসভূবন" নামে একটি বই প্রস্তুত করছেন৷ শীগ্রই এটি প্রকাশ করবেন বলে আশা ব্যক্ত করেছেন।
তিনি তার শিক্ষা ও কর্মজীবনের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠা করেছেন “হুফফাজুল কুরআন অনলাইন মাদ্রাসা” নামে একটি অনলাইন প্লাটফর্ম—যেখানে কোনোপ্রকার পারিশ্রমিক ছাড়া তিনি বিশুদ্ধ কুরআন শিক্ষা দিয়ে থাকেন সকল শ্রেণি-পেশার মানুষকে। তার এই প্লাটফর্মে দেশী ও প্রবাসী ব্যক্তিবর্গ অংশগ্রহণ করে উপকৃত হচ্ছেন। তিনি তার নিজস্ব ফেইসবুক ও ইউটিউব একাউন্টে নিয়মিত প্রকাশ করেন বিশুদ্ধ কুরআন শিক্ষার শিক্ষনীয় বিষয়গুলো। বিশেষ করে প্রশিক্ষণমূলক কন্টেন্ট প্রতিনিয়ত আপলোড দিয়ে থাকেন৷ যেগুলোতে দেখা যায় তার সুমিষ্ট কন্ঠে বিভিন্ন সুরে কিরাত শিক্ষা, মাশক, বিশুদ্ধ আজান ইত্যাদি শিক্ষা দিচ্ছেন।
তাঁর পূর্বপুরুষগণ ইসলাম প্রচারে ছিলেন অগ্রণী। তাঁর বংশের শিকড় শাহ জালাল (রহ.)-এর সোহবতে ইসলাম গ্রহণকারী আব্দুল্লাহ আল মাহমুদের সঙ্গে সম্পৃক্ত। পিতা এলাইছ মিয়া, মাতা হবিবুন নেছা এবং দাদা দরবেশ হারিছ আলীর স্মৃতিচিহ্ন বহন করে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করছেন দ্বীন ও মানবতার এক কর্মবীর হিসেবে।
সম্প্রতি তিনি দৈনিক প্রতিচ্ছবি পত্রিকার জুড়ী উপজেলা প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন এবং বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন ও সমাজের কল্যাণে কাজ করার প্রত্যয়ে অগ্রসর হচ্ছেন।
এই তরুণ কবি হাফিজ কারী সাব্বির আহমদ বিশ্বাস করেন—
“আমি একজন আদর্শ ব্যক্তিত্ব হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে চাই—যিনি শুধুমাত্র কিতাবি জ্ঞানেই নয়, বরং বাস্তব জীবনে দ্বীনের আলো ছড়িয়ে দিতে পারবেন।”
তার স্বপ্ন—জ্ঞান, চরিত্র, নৈতিকতা ও দ্বীনের শিক্ষার মাধ্যমে এমন একটি প্রজন্ম গড়ে তোলা যারা দেশ, সমাজ ও উম্মাহর কল্যাণে নিবেদিত থাকবে।
মতামত