ছবি : ইউএস-বাংলা আন্তর্জাতিক সাহিত্য ফোরাম'র প্রতিষ্ঠাতা-শাহ্ মোঃ সফিনূর
বর্তমানে বাংলা সাহিত্যের বিস্তৃত ভুবনে যারা নিবেদিতপ্রাণ হয়ে কাজ করে যাচ্ছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন শাহ্ মোঃ সফিনূর। তিনি কেবল একজন কবি বা সাহিত্যিকই নন, তিনি একাধারে সাহিত্য সংগঠক, সম্পাদক, সমাজসেবক এবং আন্তর্জাতিক বাংলা সাহিত্য আন্দোলনের একজন নিরলস কর্মী। তার সাহিত্য ও সাংগঠনিক জীবন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তিনি নিজের মেধা, শ্রম ও মননকে সমর্পণ করেছেন বাংলা ভাষার সেবা ও বিস্তারে।
শাহ্ মোঃ সফিনূর জন্মগ্রহণ করেন বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় জেলা সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার পাটলী গ্রামে। পিতা শাহ্ মোঃ দানিছ আলী ও মাতা মোছাঃ রাবেয়া বেগম। বড় ভাই শাহ্ মোঃ আলী-নূর, ছোট ভাই শাহ্ মোঃ কহিনূর, বড় বোন শাহ্ মোছাঃ হালিমা বেগম। স্ত্রী মোছাঃ সাহিদা (কালাম)। তিন মেয়ে ও এক ছেলের জনক তিনি। তারা হলো- সায়রা খাতুন শাহ্, সালমান মোহাম্মদ শাহ্, সাবায়া খাতুন শাহ্, সানায়া খাতুন শাহ্। তার জন্ম এক প্রাজ্ঞ ও সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে, যেখানে মূল্যবোধ, সংস্কৃতি ও শিক্ষার চর্চা ছিল সুপ্রতিষ্ঠিত। এই পারিবারিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট তার মননে শৈশব থেকেই সাহিত্যের প্রতি প্রবল টান সৃষ্টি করে। বর্তমানে সপরিবারে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানে বসবাস করছেন। কিন্তু তার মনটা যেন পড়ে আছে সবুজ- শ্যামল বাংলাদেশে।
তিনি শিক্ষা-জীবনে অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হওয়ার পর উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি রাজধানীতে পাড়ি জমান। তিনি প্রাইম ইউনিভার্সিটি থেকে বি.কম (অনার্স), এম.কম এবং এল.এল.বি ডিগ্রি অর্জন করেন। শিক্ষাজীবনে থাকাকালীনই তার নেতৃত্বগুণ ও সাংগঠনিক দক্ষতা পরিলক্ষিত হয়। তিনি বিভিন্ন শিক্ষার্থীবান্ধব সংগঠনের নেতৃত্বে ছিলেন এবং পরে তা বিস্তৃত হয় বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের ছাত্র ও সামাজিক সংগঠনে।
শাহ্ মোঃ সফিনূরের সাহিত্যচর্চা শুরু হয় কৈশোরেই। কাব্যপ্রেম, শব্দচর্চা এবং ভাবের গভীরতা তার লেখায় ধীরে ধীরে ফুটে উঠতে থাকে। তার কাব্যে উঠে আসে প্রবাস-জীবনের একাকিত্ব, মাটির টান, প্রেম, সমাজ- বাস্তবতা এবং ব্যক্তি-মানুষের অন্তর্জগৎ। তিনি লেখেন সহজ ও আবেগময় ভাষায়, যা সাধারণ পাঠকের হৃদয়ে সহজেই প্রবেশ করে। তিনি যৌথভাবে প্রকাশিত বহু কাব্যগ্রন্থে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। উল্লেখযোগ্য যৌথ কাব্যগ্রন্থসমূহ হলো- 'কাব্যকুঞ্জ', 'মায়াবী যুগল', 'চোখ', 'কাব্যরসের হাঁড়ি', 'দুপুরবেলার স্টেশন' ইত্যাদি। তার প্রকাশিত একক বইসমূহ হলো- 'রক্তে ভেজা শার্ট' (২০২৩), 'হৃদয় ছোঁয়া কথা' (২০২৫)। তার সম্পাদনায় প্রকাশ হয়েছে 'পানি লাগবো পানি?' (২০২৫) শিরোনামে কাব্যসংকলন যেটি কি না ২০২৪ সালে বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন (পরবর্তীতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন) চলাকালীন পুলিশের হাতে গুলিবিদ্ধ হওয়া বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসে (বিইউপি) প্রফেশনাল এমবিএ পর্যায়ের শিক্ষার্থী মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধকে উৎসর্গ করে রচিত ও সংকলিত। এছাড়া বাংলাদেশের জুলাই আন্দোলন তথা দ্বিতীয় স্বাধীনতা অর্জনের দিনগুলোকে স্মরণীয় করে রাখতে 'ইউএস-বাংলা আন্তর্জাতিক সাহিত্য ফোরাম'র ব্যানারে 'শিক্ষার্থীদের রক্তে আঁকা, ২৪ এর বিজয়ের পতাকা' শিরোনামে অনলাইন কাব্যসংকলন প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করেন তিনি। এসব উদ্যোগ ও তার কবিতা পাঠকদের মধ্যে এক প্রকার আবেগময় দোলা দেয়, যা পাঠান্তে গভীর ভাবনার জন্ম দেয়।
কবি ও সাহিত্যিকের পাশাপাশি তিনি একজন দক্ষ সম্পাদকও। ২০০১ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন একটি ত্রৈমাসিক সাহিত্যপত্রিকা 'নবজাগরণ', যা জগন্নাথপুর অঞ্চলের সাহিত্যচর্চায় নব জোয়ার এনেছিল। পরবর্তীতে তিনি আরেকটি সাহিত্যপত্র 'জয়ন্তী'র সূচনা করেন, যেখানে নতুন ও পুরাতন কবি-লেখকরা অভিন্ন প্ল্যাটফর্মে এসে মিলিত হন। এই দুটি পত্রিকাই সাহিত্যের জগতে তার বহুমাত্রিক অবদানকে চিহ্নিত করে। শাহ্ মোঃ সফিনূরের নেতৃত্বগুণ কেবল সাহিত্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং সমাজ ও শিক্ষাক্ষেত্রেও তিনি রেখেছেন দৃষ্টান্তমূলক অবদান। তিনি ছিলেন- জগন্নাথপুর ছাত্রকল্যাণ পরিষদের সাধারণ সম্পাদক, সিলেট ল' কলেজ ছাত্রকল্যাণ পরিষদ (সুনামগঞ্জ জেলা শাখা)-এর সভাপতি, সিলেট বিভাগের উন্নয়ন সংক্রান্ত আহ্বায়ক, সিলেট লিও ক্লাবের সহ-সভাপতি, পাটলী যুবসংঘের সভাপতি। এই সংগঠনগুলোতে তার কর্মনিষ্ঠা, সহানুভূতি ও আদর্শিক নেতৃত্ব অসংখ্য তরুণকে অনুপ্রাণিত করেছে।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের আন্তর্জাতিক বিস্তারে শাহ্ মোঃ সফিনূরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে। তা হলো 'ইউএস-বাংলা সাহিত্য সম্মেলন'র আয়োজন। প্রবাসে থেকেও তিনি বাংলা ভাষার চর্চা ও প্রচারে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। এই সম্মেলনের মাধ্যমে তিনি দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে থাকা বাংলাভাষী কবি-সাহিত্যিকদের একত্র করেন। এই সাহিত্য সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী কবি ও লেখকরা পারস্পরিক সাহিত্য বিনিময়ের সুযোগ পেয়েছিলেন, যা বাংলা সাহিত্যকে দিয়েছে নতুন গতি ও দিগন্ত। তিনি 'ইউএস-বাংলা আন্তর্জাতিক সাহিত্য ফোরাম' এর প্রতিষ্ঠাতা।
শাহ্ মোঃ সফিনূরের সাহিত্যের সৌন্দর্য তার হৃদয়ের গভীরতা থেকে উৎসারিত। তার প্রতিটি কাজ প্রমাণ করে, তিনি কেবল নিজের জন্য নয়, জাতি ও ভাষার বৃহত্তর কল্যাণে নিবেদিতপ্রাণ। তিনি আমাদের সেই লেখক- সংগঠকদের একজন, যারা নিজের কর্ম ও লেখালেখির মাধ্যমে বাংলা ভাষার পতাকা প্রবাসে উড়িয়েছেন গর্বের সাথে। শাহ্ মোঃ সফিনূর আজ বাংলা সাহিত্যের এক শ্রদ্ধেয় ও পরিচিত নাম। তিনি প্রমাণ করেছেন, প্রতিকূলতা সত্ত্বেও স্বপ্ন দেখা যায়, স্বপ্ন ছুঁয়েও ফেলা যায়-যদি থাকে নিষ্ঠা, সাহস ও কাজের প্রতি ভালোবাসা। তার সাহিত্য এবং সংগঠন-নির্মাণের যাত্রা আমাদের অনুপ্রেরণা জোগায়, সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা ও দায়বদ্ধতা শেখায়। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের যে নীরব বিপ্লব চলছে বিশ্বজুড়ে, সেখানে তার অবদান অবিস্মরণীয়।
মতামত