বিশেষ সংবাদ

উন্নয়ন, ঐতিহ্য ও সাফল্যে অনন্য চুন্টা ইউনিয়ন– এগিয়ে যাচ্ছে নতুন সম্ভাবনায়।

প্রিন্ট
উন্নয়ন, ঐতিহ্য ও সাফল্যে অনন্য চুন্টা ইউনিয়ন– এগিয়ে যাচ্ছে নতুন সম্ভাবনায়।

প্রকাশিত : ০৮ জুন ২০২৫

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সরাইল উপজেলার অন্তর্গত চুন্টা ইউনিয়ন একটি ঐতিহ্যবাহী ও সংগ্রামী জনপদ। বিলুপ্ত প্রায় নদী ও দিঘি পরিবেষ্টিত এই অঞ্চল ইতিহাস, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় মূল্যবোধে সমৃদ্ধ।

জনশ্রুতি মতে, চুন্টা নাম দুটি মতবাদ দ্বারা ব্যাখ্যা করা হয়— একদিকে চুন্টা একটি বিল (জলাশয়) যেখানে মাটি ভরাট করে প্রাচীন সেন বংশের লোকেরা বসতি স্থাপন করেছিল। অন্যদিকে “চন্ডা” (বৌদ্ধ মন্দির এলাকা) থেকে “চুন্টা” নামের উৎপত্তি— যেখানে ষোড়শ শতাব্দীতে নবদ্বীপ রাজ্যের প্রতিনিধি এসে বসতি গড়েন এবং এখনো “চুন্টার বৌদ্ধ মন্দির” রয়েছে ।

গ্রামে জামে মসজিদ সহ ২২টির মতো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যা স্থানীয় ঐতিহ্য ও ধার্মিকতা প্রতিফলিত করে । চুন্টা ইউনিয়ন শুধু একটি গ্রামের নাম নয়— এটি ইতিহাস, সংগ্রাম, ঐতিহ্য, প্রতিবাদ ও প্রগতির জীবন্ত দলিল। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে চুন্টা ছিল সরাইল উপজেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ রণাঙ্গন। পাকিস্তানি সেনাদের গণহত্যায় শতাধিক নিরীহ গ্রামবাসী শহীদ হন। সেই ত্যাগ ও আত্মাহুতির স্মৃতি আজও এই জনপদের আত্মপরিচয়ের অংশ।

চুন্টা গণহত্যা: প্রায় ৩১ জন গ্রামবাসী শহীদ হন। স্থানীয় নেতৃত্বে গঠিত হয় শান্তি কমিটি ও প্রতিরোধ বাহিনী, নেতৃত্বে ছিলেন এমদাদুল হক টেকাবালী। এটি প্রমাণ করে, এই ইউনিয়ন শুধু নিপীড়নের শিকার নয় বরং সাহসী প্রতিরোধেরও গর্বিত সাক্ষী। চুন্টা থেকে প্রকাশিত ‘চুন্টা প্রকাশ’ নামে একটি পত্রিকা, যা এক সময়ে বহুল প্রচলিত ছিল এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গ্রামীণ সংবাদপত্রের ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করে। গ্রামের কৃতি সন্তান ডঃ সুধীর চন্দ্র সেন ১৯৫২ সালে ভারতের জাতীয় সংসদের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেন— এটি এই এলাকার জন্য এক বিশাল সম্মান।

এই ইউনিয়নে শিক্ষা ব্যবস্থা দিন দিন উন্নতির পথে এগিয়ে চলেছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার প্রসারে সরকার ও স্থানীয় উদ্যোগ একত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়: ১৮টি, মাধ্যমিক বিদ্যালয়: ১টি— চুন্টা অবিনাশ চন্দ্র একাডেমি।

পুরুষ শিক্ষার হার ২৬.২৩%, নারী শিক্ষার হার ২০.০৮%, প্রাথমিক শিক্ষায় ঝরে পড়ার হার ০%, মাধ্যমিকে ঝরে পড়ার হার ৮.৯৬%, উল্লেখ যোগ্য বিষয় হলো, প্রাথমিক শিক্ষায় ঝরে পড়ার হার প্রায় শূন্য শতাংশ, যা চুন্টার একটি গর্বের বিষয়। চুন্টা অবিনাশ চন্দ্র একাডেমি মাধ্যমিক পর্যায় শুধু শিক্ষার জন্য নয়, সামাজিক উন্নয়নেও অবদান রেখে চলেছে। এই স্কুলের নামে তৈরি হচ্ছে ওয়েবসাইট, যেখান থেকে শিক্ষক, ছাত্র/ছাত্রী, অভিভাবক সকলেই সকলের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে যা শিক্ষা ব্যবস্থায় নিয়ে আসবে ডিজিটাল সুবিধা।

চুন্টা একটি কৃষিনির্ভর অঞ্চল তবে কৃষিনির্ভর হলেও এখানকার প্রকৃতি অত্যন্ত মনোরম। বিস্তৃত ধানক্ষেত, নদী-জলাশয়, দিঘি ও গাছপালা গ্রামের সৌন্দর্য বাড়িয়েছে বহুগুণে। স্থানীয়রা ধান, সবজি ও মাছ চাষে সাফল্য পেয়েছেন। চুন্টার প্রতিটি জমি যেন একেকটি সোনার খনি। শুধু ফসল নয়, প্রকৃতিও এখানে দান করেছে তার সমস্ত সৌন্দর্য। এখানকার মাঠ, বিল আর গাছপালায় গ্রামীণ সৌন্দর্য ও কৃষির এক অপূর্ব মেলবন্ধন সৃষ্টি হয়েছে। তিতাস নদীর তীরবর্তী হওয়ায় চুন্টা কৃষি কাজে সমৃদ্ধ। গৃহস্থালি কৃষি, বিদেশ প্রবাসী আয় ও ক্ষুদ্র ব্যবসা মিলিয়ে চুন্টা আর্থিক ভাবে দিন দিন সচল হচ্ছে।

মেঘনা ও তিতাস নদীবেষ্টিত এ অঞ্চলের জনপদে গড়ে উঠেছে এক সমৃদ্ধ গ্রামীণ জীবনধারা। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যে ভরপুর চুন্টা। চুন্টা ইউনিয়নের মানুষের মধ্যে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাস, ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সামাজিক মূল্যবোধ এবং প্রবাসী সমাজের দৃঢ় অবদান। এখানকার মানুষ কৃষিকাজ, ব্যবসা, শিক্ষা ও প্রবাসে কর্মসংস্থানের মাধ্যমে দেশ ও সমাজে অবদান রেখে চলেছেন।

আজকের এই ডিজিটাল যুগেও চুন্টার তরুণ প্রজন্ম আধুনিক প্রযুক্তি, শিক্ষা ও সামাজিক অগ্রগতির সাথে নিজেদের গড়ছে নতুন করে। শিক্ষা, সাংবাদিকতা, সংস্কৃতি, খেলাধুলা ও সামাজিক কাজেও এখানকার মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণ রয়েছে।

চুন্টা শুধু একটি ইউনিয়ন নয়— এটি ইতিহাস, আত্মত্যাগ, সম্ভাবনা ও পরিবর্তনের প্রতীক।