ছবি : সান্ডার লেজে থাকা কাঁটা তার প্রধান প্রতিরক্ষা অস্ত্র
সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওর মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের এক রহস্যময় প্রাণী “সান্ডা” নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে। ভিডিওতে এক প্রবাসী বাংলাদেশিকে মরুভূমিতে সান্ডা ধরতে এবং পরে সেটি খেতে দেখা যায়। এই ব্যতিক্রমী অভিজ্ঞতা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ফেসবুক, টিকটক এবং ইউটিউবসহ বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্মে। মুহূর্তেই এটি নেটিজেনদের কৌতূহল, কৌতুক ও সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়।
ভিডিওটি ভাইরাল হওয়ার পর থেকেই অনেকের মনে প্রশ্ন জাগছে আসলে “সান্ডা” কী? কেন এটি খাওয়া হয়? আর কেনই বা এটি নিয়ে এতো চর্চা?
‘সান্ডা’ নামটি মূলত কোনও নির্দিষ্ট এক প্রাণীর নাম নয়। এটি একটি গোত্র বা শ্রেণিভুক্ত প্রাণীর সাধারণ নাম। এর বৈজ্ঞানিক নাম Uromastyx, যা “স্পাইনি টেইলড লিজার্ড” বা কাঁটাযুক্ত লেজওয়ালা টিকটিকি নামে পরিচিত। এই প্রাণীটি Agamidae পরিবারভুক্ত এবং পৃথিবীতে এর অন্তত ১৮টিরও বেশি প্রজাতি রয়েছে। মরুভূমি ও শুষ্ক অঞ্চলে বসবাসকারী এই লিজার্ডগুলোকে মধ্যপ্রাচ্যে ‘ধাব’ নামে ডাকা হয়।
এরা মূলত আফ্রিকার উত্তরাঞ্চল, আরব উপদ্বীপ, ইরান, পাকিস্তান এবং ভারতের রাজস্থান ও গুজরাট অঞ্চলে পাওয়া যায়। সৌদি আরব, কুয়েত, ওমান, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং বাহরাইন-এর বিস্তীর্ণ মরুভূমিই এদের প্রাকৃতিক আবাসস্থল।
সান্ডার শরীর সাধারণত মোটা ও শক্ত কাঠামোর। গড় দৈর্ঘ্য ২৫-৩০ সেন্টিমিটার হলেও কিছু কিছু প্রজাতি ৪০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বড় হয়ে থাকে। এদের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো লেজ যেটি মোটা, শক্ত এবং ধারালো কাঁটায় ভরা। শিকারির হাত থেকে বাঁচার জন্য এই লেজ দিয়েই আত্মরক্ষা করে।
তাপমাত্রা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এরা গায়ের রংও বদলায়। ঠান্ডায় গাঢ় রঙ ধারণ করে সূর্যের তাপ শোষণ করে এবং গরমে হালকা রঙ ধারণ করে শরীর ঠান্ডা রাখে। এই রঙ বদলের ক্ষমতা এদের পরিবেশ অভিযোজনে বিশেষভাবে সহায়ক।
সাধারণত নিরামিষভোজী হলেও এরা ছোট পোকামাকড়ও খায়। গাছের পাতা, ফুল ও ফলমূল এদের প্রধান খাদ্য। দিনের বেলায় সূর্যস্নানে মগ্ন থাকে, আর সন্ধ্যা হলে গর্তে গিয়ে লুকিয়ে পড়ে।
মধ্যপ্রাচ্যে বিশেষত বেদুঈন জনগোষ্ঠীর মধ্যে সান্ডা একটি প্রচলিত খাবার। কেউ কেউ একে ‘মরুভূমির মুরগি’ বলেও আখ্যা দেয়। এর সাদা মাংসকে সুস্বাদু ও পুষ্টিকর বলে মনে করা হয়। কখনও কখনও এর বিরিয়ানিও রান্না করা হয়।
ভারত ও পাকিস্তানেও সান্ডা খাওয়ার ঐতিহাসিক প্রচলন রয়েছে। বিশেষ করে হিন্দু বর্ণপরিচয়ের কিছু গোষ্ঠীর মধ্যে এটি এক ধরনের ‘পাহাড়ি খাবার’ হিসেবে বিবেচিত হয়। সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ হলো লেজ, যা চর্বিযুক্ত এবং সুস্বাদু বলে বিশ্বাস করা হয়।
ইসলামে সান্ডা খাওয়ার বিষয়ে একাধিক হাদীস পাওয়া যায়। সহিহ বুখারী ও সহিহ মুসলিমে বর্ণিত আছে, একবার সাহাবিরা নবী করিম (সা.)-এর সামনে সান্ডা পরিবেশন করলে তিনি তা খাননি। তবে তিনি স্পষ্ট করে বলেছিলেন এটি আমার কওমের খাদ্য নয়, তাই আমি খাই না।" অর্থাৎ, তিনি নিষেধ করেননি।
ফিকহশাস্ত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে হানাফি মাজহাবে একে মাকরূহ তাহরিমি বলা হয়েছে অর্থাৎ না খাওয়াই শ্রেয়। কিন্তু শাফেয়ি, মালিকি ও হাম্বলি মাজহাবে একে সম্পূর্ণ হালাল ঘোষণা করা হয়েছে।
সান্ডার জনপ্রিয়তার আরেকটি বড় দিক হলো এর তেল। ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে এই তেলকে “সান্ডা তেল” নামে প্রচার করা হয়। দাবি করা হয়, এটি যৌনশক্তি বৃদ্ধিতে কার্যকর। বহু হেকিমি ও আয়ুর্বেদ চিকিৎসায় একে ‘প্রাকৃতিক ভায়াগ্রা’ বলা হয়ে থাকে।
তবে আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান এই দাবিকে ভিত্তিহীন বলেই মনে করে। এখন পর্যন্ত কোনো গবেষণায় প্রমাণিত হয়নি যে সান্ডা তেল পুরুষত্ব বৃদ্ধি করে। বরং অজ্ঞাত উৎসের এই তেল ব্যবহার করে চর্মরোগ, অ্যালার্জি, হরমোনের অসাম্য ইত্যাদি শারীরিক সমস্যা তৈরি হতে পারে।
অতিরিক্ত শিকার, আবাসস্থল ধ্বংস, এবং সান্ডা তেলের অবৈধ বাণিজ্যের কারণে বর্তমানে এই প্রাণীটি বিপন্ন প্রাণীর তালিকায় চলে গেছে। ভারতের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন, ১৯৭২ অনুসারে একে প্রথম তফসিলভুক্ত করা হয়েছে যা সর্বোচ্চ সুরক্ষা প্রদান করে।
সৌদি আরবে অনুমতি ছাড়া ধাব শিকার বা বাণিজ্য করলে ৩ কোটি সৌদি রিয়াল জরিমানা বা ১০ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে। পাকিস্তানে আইন থাকলেও কার্যকর নজরদারির অভাবে শিকার অব্যাহত রয়েছে।
জাতিসংঘ পরিবেশ সংস্থা ও IUCN-এর মতে, সান্ডার কিছু প্রজাতি ইতোমধ্যে ‘Threatened Species’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে এর তেল ও মাংসের চাহিদা একে অস্তিত্ব সংকটে ফেলেছে।
সান্ডা শুধু একটি মরুভূমির প্রাণী নয়, এটি একটি বাস্তুতন্ত্রের অংশ, একটি প্রাকৃতিক ভারসাম্যের রক্ষাকবচ। এ প্রাণী সম্পর্কে অজ্ঞতা ও কুসংস্কারের কারণে এর অস্তিত্ব আজ হুমকির মুখে। সান্ডা নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণা, সামাজিক সচেতনতা, আইন প্রয়োগ এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে।
আমাদের বুঝতে হবে, প্রকৃতির কোনো উপাদানই অকারণে সৃষ্টি হয়নি। তাই কেবল লোকজ বিশ্বাসে ভর করে একটি প্রাণীকে বিলুপ্তির পথে ঠেলে দেওয়া নয়—বরং যুক্তি, বিজ্ঞান ও সহানুভূতির আলোকে এর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি গঠন করা উচিত
মতামত